আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটির জন্মদিন।সেই মানুষটির জন্মদিনে প্রকৃতি একটুও নতুনভাবে সাজলো না! এটা আমি মেনে নিতে পারছি না!শরতের ফকফকে নীল আকাশ,পেঁজা তুলোর মতো হালকা মেঘ,আর অনেক অনেক পাখি ঘুম ভেঙে সূর্যের ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে। কোনো একদিক থেকে স্নিগ্ধ বাতাস আসছে। দিক জানি না।প্রাচ্য আর প্রতীচীই কেবল আমার জানা।মেরুর খবর নেবার ফুসরত জোটে না।
আমাদের ছোট্ট এক তলা বাড়িটির,তিনদিকে জানালা বিশিষ্ট একমাত্র ঘরে,সারারাত ধর্না দিয়ে পড়ে থাকা ক্লান্ত ঘুম দৃষ্টি কেড়েছে তার৷ নাহ্, কোনো মিস ইউনিভার্স কিংবা ওয়ার্ল্ড নয়। এমনকি,মিস বাংলাদেশ ও নয়।
অত্যন্ত সাদামাটা,অলক্ষণীয় বাঙালি নারী।
না,না। একেবারেই মিথ্যে বলছি না।একটু মন দিলেই বোঝা যাবে।তার শক্তিতে,সাহসে,মেধায়,মননে, নান্দনিকতায়, বলিষ্ঠতায় সে অনন্য। আমার জীবনে আমি ওরকম দুটো দেখিনি।সাদামাটা,স্বচ্ছ; অথচ কি দারুন!
আর, আজ তারই জন্মদিন। অথচ আড়ম্বর নেই।
গতকাল সারারাত ঘুমাইনি। যেই ফার্মটা এখানে শ’খানেক পরিবারের অন্ন যোগায়,সেই আমাদের ফার্মটার ছোটোখাটো কাজে ১৩-১৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের নেবো।প্ল্যান হচ্ছে যে যখন সুযোগ পাবে কাজ করে দিয়ে যাবে,বাবা মাকে সাহায্য করবে।টাকাও পাবে।উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বনির্ভরতার শিক্ষা দেওয়া।আশা করা যায়,আজ থেকেই শুরু করা হবে। আমি এখানকার পল্লী বিদ্যুৎ এর সর্বোচ্চ কর্মকর্তা।নানা চেষ্টায় প্রমোশন আটকে দিয়ে এখানে পড়ে আছি। আর আমার প্রাণ এখানে প্রাণ বিলোচ্ছে। আমরা দুজনেই দেশের মানুষের টাকায় পড়েছি। তাই,একটু চেষ্টা,এই যা।
আমাদের ছাদটা খুব সুন্দর করে সাজানো। বাহারী রঙের ফুলের গাছ, ঔষুধি গাছ। চোখটা স্বস্তি পেল যেন৷ সূর্য উঠবে।আমার জীবনেও কি?
.
.
.
.
“এই যাহ,ঘুমিয়ে পড়লাম! পর্দা টেনে দেয়া হয়েছে,ভালো।আজ কত্ত কাজ,জানে না যেন।”
খটখট আওয়াজ শুনে নিচে এসে দেখি ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা বাজে।এর মানে তো ঘুম শেষ।পুবদিকের জানালা থেকে সূর্যোদয় আরো সুন্দর লাগে।রান্নাঘরে চুলা জ্বলছে।ফুটন্ত গরম পানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।একটু পরে চা ঢালা হবে।সুঘ্রাণে ভরে যাবে ঘরটা।
আচ্ছা,আওয়াজটা কি আমার মাথায় হচ্ছে? সেরিব্রো- স্পাইনাল ফ্লুইড কি গরম পানির মতো ফুটছে?
আজই আমাদের বিয়ের তিন বছর হলো।আজকের দিনটার সাথে আমাদের দুজনের জীবনের অনেক কিছু জড়িয়ে আছে।আজ আমার প্রাণের নতুন জন্মের দিন,সে কথা তো আগেই বলেছি।আজ আরো একটা বিশেষ দিন।তিন বছর আগে ঠিক এই দিনটায় আমার খুব কাছের দুজনের মৃত্যু হয়েছে।আমার প্রেমিকা আর তার প্রেমিক। একজন প্রাণে – দেহে আরেকজন শুধুই প্রাণে।
আমাদের বিয়ের আগেও এই সুন্দরতম মানুষটিকে চিনতাম আমি।তখন ও সে সুন্দর ছিল। সে সুন্দর ছিল তার মেধায়,মননে,নান্দনিকতায়, লালিত্যে।তারপর সেই বর্ষা এলো।আমার মনের মিইয়ে যাওয়া মানুষটাকে এত মিইয়ে দিল যে….।সেই শরতেই মরতে হলো একজনকে প্রাণে – দেহে,আরেকজনকে শুধুই প্রাণে। জন্ম ও হলো অনেক কিছু।আমার জীবনের সুন্দরতম মানুষ, শত পরিবারের সঞ্জীবনী।
এখনো, তিন বছর পরেও এই সুন্দরের পাশে আমি থাকি,তার কাছের মানুষ হয়ে৷ অথচ একদিন সে ই আমায় বন্ধু বলে কাছে রেখেছিল। যদিও আমার দেহ সম্বল,তবুও বেঁচে আছি।বিবেকের হাত থেকে সে আমায় বাঁচাতে পারেনি।কিন্তু, বিবেকের দেওয়া ক্ষতটা সারিয়ে দিতে ভুলেনি।
“আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।বিয়েটা আমি করবো না।”কথাটা সেদিন বললে হয়তো তেমন কিছুই বদলাতো না ,আবার হয়তো অনেক কিছুই বদলাতো। প্রেমিকার জীবন,নিজের প্রাণ এসব কিছুই হারাতে হতো না।আবার হারাতে হতো এই মানুষটার সঙ্গ,ওই সঞ্জীবনী সুধা,জন্ম নিত না এই সৌন্দর্য। যেই সৌন্দর্য আমার প্রাণ….।
ক্রমাগত হয়ে উঠছে আমার রেনেসাঁর উৎস,ভালোবাসার উৎস,আমার জীবন।